ছবির রং (সপ্তম অধ্যায়) (হাশেম খান)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সপ্তবর্ণা গদ্য | - | NCTB BOOK
94
94

ছবি আঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে?
কাগজ তো সাদা। পেনসিলে আঁকা যায়। হাতের কলমটা দিয়েও আঁকা যায় এই সাদা জমিনে।
রং হলে খুউব ভালো হয়। ইচ্ছেমতো লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ, কালো রং ঘষে ঘষে সাদা কাগজটা ভরে ফেলা যায়। সুন্দর এক রঙিন ছবি আঁকা হয়ে যায়।

হলুদ, নীল ও লাল এই তিনটিই কিন্তু আসল রং। এই তিন রং থাকলে নানা রঙে ভরা পরিপূর্ণ রঙিন ছবি আঁকা যায়। এই তিনটি রং মিলিয়ে মিশিয়ে অনেক রং পাওয়া যায়। যেমন-

হলুদ ও নীল মেশালে পাবে সবুজ।
নীল ও লাল মেশালে পাবে বেগুনি।
লাল ও হলুদ মেশালে পাবে কমলা।

এভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি রং বা একাধিক রং মিশিয়ে কত রকম রং যে পাওয়া যায় তার মধ্যে কয়েকটি রং ছাড়া সবগুলো সঠিক নামে চেনা সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে লাল, হলুদ ও নীল এই তিনটিই হলো মৌলিক রং বা প্রাথমিক রং। সবুজ, কমলা ও বেগুনি হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের বা মাধ্যমিক রং এবং অন্যান্য রং পরবর্তী পর্যায়ের। সাদা ও কালো রং ছবি আঁকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক রং মিলিয়ে মিশিয়ে এই দুটো রং পাওয়া যাবে না। তবে সবুজ ও লাল ঘন করে মিশিয়ে কালোর কাছাকাছি গাঢ় একটি রং তৈরি করা সম্ভব।

রংধনুর সাতটি রং। বৃষ্টির পর আকাশে যখন রংধনু ফুটে ওঠে, একটি একটি করে গুণে সাতটি রং খুঁজে বের করা যায়। হলুদ, কমলা, লাল, সবুজ, নীল, বেগুনি ও গোলাপি।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। বছরের ১২ মাসকে আমরা ২ মাস করে প্রকৃতি ও আবহাওয়ার কারণে ভাগ করে নিয়েছি।

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এই ২ মাস গ্রীষ্মকাল। আবহাওয়া থাকে শুষ্ক ও গরম। বৃষ্টি হয় কম। গাছপালা, খাল-বিল-নদী শুকিয়ে যায়। প্রচণ্ড রোদে গাছের সবুজ-সতেজ রং বিবর্ণ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করে আকাশে কালো রঙের মেঘের ছুটাছুটি, বিদ্যুৎ চমকানো, সঙ্গে কানে তালালাগা প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয়। তারপর ঝড় ও বৃষ্টি। প্রকৃতিতে রঙের নানা রকম খেলা চলে। রং-বেরঙের ফল আম, জাম, কলা, লিচু, তরমুজ এই গ্রীষ্ম ঋতুতে পাওয়া যায়। লাল, নীল, কালো, হলুদ, গোলাপি, কমলা সবুজ রঙের এই বাহারি ফলগুলোর স্বাদও মিষ্টি।

বর্ষাকাল হলো আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। ঝিরঝিরে অল্প বৃষ্টি থেকে ঝর ঝর করে প্রবল বেগে বৃষ্টি হয় এ সময়। মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, ঝিল-বিল পানিতে টইটুম্বুর। পানি পেয়ে গাছপালা সতেজ হয়ে যায়- নানা রকম সবুজ রঙে ভরে যায় গাছপালা, বন-জঙ্গল, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত ইত্যাদি। সাদা ও কমলা রঙের কদম ফুল বর্ষা ঋতুর ফুল। এই ঋতুতে সতেজ ও সবুজ কচুবনে যখন কমলা রঙের লম্বা লম্বা ফুল ফোটে, চমৎকার লাগে দেখতে। কচুফুল তরকারি হিসেবেও সুস্বাদু।

শরৎকাল- সাদা ও স্বচ্ছ নীলের ছড়াছড়ি। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস শরৎকাল। এ সময়ে বৃষ্টি বসে যায়। সুন্দর নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ ভেসে বেড়ায়। গাছপালা নদীনালা প্রকৃতির সবকিছু এই ঋতুতে ঝকঝকে। নদীর ধারে ও বিলে অল্প পানিতে কাদামাটিতে সবুজ গাছ থেকে বের হয়ে আসে নরম সাদা কাশফুল। বাতাসের দোলায় এই কাশফুল যখন দোলে, সুন্দর নরম রঙের কারণে মন তখন আনন্দে নেচে ওঠে। বিলে, পুকুরে এ সময় শাপলাফুল ফোটে। বেশির ভাগ শাপলা সাদা, লাল শাপলাও আছে যা দেখতে খুবই সুন্দর। ভরা নদী ও খালে সাদা, লাল, নীল ও হলুদ বিভিন্ন রঙের পালতোলা নৌকা-চলাচলের দৃশ্য মোহনীয়।

হেমন্ত ঋতু হলো কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। সবুজ ধানক্ষেতের রং হলুদ হতে শুরু করে। ঋতুর শেষ দিকে - অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে পুরো মাঠে হলুদ বা গেরুয়া রঙের বাহার। ধান পেকে গেছে। চাষিরা দল বেঁধে ফসল কাটা শুরু করে।

এরপরেই পৌষ ও মাঘ মাস- - শীতকাল। বনে-জঙ্গলে, বাড়ির আঙিনায় সর্বত্রই নানা রঙের ফুল ফোটা শুরু হয়। এই ফুল ফোটা শীতের পরে বসন্ত ঋতু পর্যন্ত চলতে থাকে। শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া গাছে যখন ফুল ফোটে, হলদে গাছের ঝলমলে হলুদ রঙের ফুলে পুরো প্রকৃতি যেন রঙের উৎসবে মেতে ওঠে। মাঠে তিলের ক্ষেতে সাদা ও হালকা বেগুনি ফুল এবং সরষের ক্ষেতে ফুলে ফুলে হলুদের বন্যা নামে এই শীতকালেই। শীতের কারণে মানুষের পোশাকে আসে রঙের বৈচিত্র্য। লাল, নীল, হলুদ, কালো বিচিত্র রঙের গরম কাপড় ও টুপি ব্যবহার করে মানুষ।

শীতকালে কুয়াশাও প্রকৃতিতে ধোঁয়াটে ধরনের এক মায়াবী রং আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। খুবই ঠান্ডা ও বরফ-পড়া দেশ থেকে চলে আসে আমাদের দেশে লক্ষ পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে এরা আশ্রয় নেয় আমাদের দেশের খালে-বিলে-নদীতে যাদের বলা হয় অতিথি পাখি। রং-বেরঙের পালক এসব পাখির। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে এরা আবার চলে যায় নিজের দেশে।

ফাল্গুন ও চৈত্র বসন্তকাল। ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। এ সময় গাছে গাছে যেন প্রতিযোগিতা- কে কত সুন্দর ও সতেজ ফুল ফোটাতে পারে। নানা রঙের পালকে সেজে ছোটবড় সব পাখি গাছে গাছে নেচে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়। ফুলের মধু খেয়ে উড়ে বেড়ায় আনন্দে। অন্যদিকে হাজার লক্ষ রঙিন প্রজাপতি। এত রং-বেরঙের যে হিসেব করা সম্ভব নয়। নানা রঙের মোহময় প্রেরণায় মানুষও স্বভাবসুলভ আনন্দে মেতে ওঠে। বাসন্তী ও উজ্জ্বল রঙের পোশাকে, সাজসজ্জায় উৎসবে মেতে ওঠে। তাই বসন্ত ঋতুই হলো রঙের ঋতু।

অনেক কাল আগে থেকেই বাংলাদেশের ষড়ঋতুতে আমাদের পরিবেশে, নিসর্গে উজ্জ্বল-সুন্দর নানা রঙের যে সমাবেশ ঘটেছে রূপের রকমফের ঘটে চলেছে তা বাঙালির মনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই আমরা দেখি আমাদের গ্রামীণ সমাজের লোকশিল্পীরা মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, কাপড় ও তুলার পুতুল, সোনার পুতুল, লক্ষ্মীসরা, শখের হাঁড়ি, নকশিকাঁথা, হাতপাখা, পাটি, গল্প বলার পটে তথা লোকশিল্পে উজ্জ্বল ও সতেজ রং ব্যবহার করে ছবি ও শিল্পকে সুন্দর ও মোহনীয় রূপ দিয়ে চলেছে তাঁতে তৈরি কাপড়ে তাঁতিরা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের তৈরি তাঁতের পোশাকে রঙিন সুতোর বুনটে নানা রঙের ঝলমলে মনকাড়া সব শাড়ি ও পোশাক বানিয়ে চলেছে। আমাদের শিশুরা এখন ছবি আঁকে। বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিশুদের ছবির রং অনেক উজ্জ্বল, সাহসী এবং মৌলিক রং ঘেঁষা। তাই খুব সহজেই বাংলার শিশুদের ছবিকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চেনা যায়।

চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পীদের ছবির সামনে দাঁড়ালে একই কথা মনে হবে। বাংলাদেশের শিল্পীরা অনেক মুক্ত, সহজ ও সাহসী। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি, কমলা, কালো ও সাদা রংকে শিল্পীরা সুন্দরভাবে ছবিতে, নকশিকাঁথায়, হাতপাখায়, পুতুলে, হাঁড়িপাতিলে ব্যবহার করছেন। তাই বাংলার শিল্পীদের শিল্পকর্ম সারা বিশ্বে প্রশংসা পাচ্ছে।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

41
41

খুউব - খুব। জোর দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে খুউব।
মৌলিক রং - যার মধ্যে অন্য কোনো রঙের মিশ্রণ ঘটেনি। একটি মাত্র রঙে গঠিত।
ষড় - ছয়।
প্রচণ্ড - কড়া, কঠোর।
গেরুয়া - মাটির মতো রং।
বাহার - শোভা, সৌন্দর্য।
সর্বত্র - সব জায়গায়।

common.content_added_and_updated_by

পাঠের উদ্দেশ্য

46
46

ঋতুভেদে প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করে তোলা।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি

35
35

আমরা চারপাশে গাছ-লতাপাতা, ফুল, মাঠ, নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি দেখি। তাদের রূপ আছে। রং আছে। সেই রূপকে নানান রঙে নিজের মতো যাঁরা আঁকেন তাঁদের আমরা বলি চিত্রশিল্পী। বিভিন্ন ঋতুতে আমাদের চারপাশের পরিবেশের রূপ ও রং বদলে যায়। চিত্রশিল্পীরাও তাঁদের ছবিতে রঙে-রেখায় ফুটিয়ে তোলেন। ছবির সেই নানান রং ও রঙের বৈচিত্র্যের কথাই লেখক হাশেম খান তাঁর 'ছবির রং' লেখাটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

43
43

শিল্পী হাশেম খান ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে চাঁদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চিত্রকলা বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও ঢাকা নগর জাদুঘরের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: 'ছবি আঁকা ছবি লেখা', 'জয়নুল গল্প', 'গুলিবিদ্ধ ৭১'।

common.content_added_by

কর্ম-অনুশীলন

39
39

ক. প্রকৃতিনির্ভর ছড়া, কবিতা বা গল্প লিখে দেয়াল-পত্রিকা প্রকাশ (শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর দলগত কাজ)।
খ. প্রকৃতিনির্ভর ছবি এঁকে প্রদর্শনীর আয়োজন (শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর দলগত কাজ)।
গ. শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে নিয়ে সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন।

common.content_added_by

নমুনা প্রশ্ন

48
48
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. ছবি আঁকার মৌলিক রংগুলো কী?
ক. হলুদ, সবুজ ও বেগুনি
খ. লাল, হলুদ ও কমলা
গ. লাল, নীল ও হলুদ
ঘ. হলুদ, নীল ও সবুজ

২. মাঠে গেরুয়া বাহার দেখে বোঝা যায়-
i. অগ্রহায়ণ মাস চলছে
ii. মাঠে ধান পেকেছে
iii. মানুষের পোশাকে বৈচিত্র্য এসেছে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. iও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়ো বোনের সাথে বেড়াতে যায় সবিতা। সেখানে তার বোন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখায়। হঠাৎ সবিতার চোখ ক্যাম্পাস-সংলগ্ন বিলে আটকে যায়। সেখানে রংবেরঙের
হাজার হাজার পাখির মেলা বসেছে। কিন্তু কোনো পাখিই তার পরিচিত নয়।

৩. উদ্দীপকের অচেনা পাখিগুলো ছবির রং রচনায় উল্লেখিত কোন ঋতুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়?
ক. বর্ষাকাল
খ. শরৎকাল
গ. শীতকাল
ঘ. বসন্তকাল

8. উদ্দীপকে উল্লেখিত পাখিগুলোকে আমাদের দেশে কী বলে?
ক. মায়াবী পাখি
খ. রংবেরঙের পাখি
গ. বসন্তের পাখি
ঘ. অতিথি পাখি

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. গত ডিসেম্বরে রিংকু তার মামার বাড়ি আলোকদিয়ায় বেড়াতে যায়। তার মা তাকে সেখানকার বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। বিদ্যালয়প্রাঙ্গণে নানা রঙের অনেক ফুল আর প্রজাপতি দেখে সে মুগ্ধ হয়। সেখানে সে শিক্ষার্থীদের তৈরি উজ্জ্বল রঙের নানা ধরনের পুতুল, বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকা ছবি দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে।
ক. চাষিরা কোন মাসে দল বেঁধে ফসল কাটে?
খ. 'এই তিনটি রং মিলিয়ে মিশিয়ে অনেক রং পাওয়া যায়।'- ব্যাখ্যা কর।
গ. বিদ্যালয়ের দৃশ্যে 'ছবির রং' প্রবন্ধের কোন ঋতুর পরিচয় পাওয়া যায়?- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. "উদ্দীপকটি 'ছবির রং' প্রবন্ধের আংশিক ভাব প্রকাশ করছে।"- বিশ্লেষণ কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion